চৈত্র মাস, বেশ গরম পড়ছে। কাঁধে কলেজ ব্যাগ, একজন ছাত্র, এসে দাঁড়ালো, ছোট্ট একটি হোটেলের সামনে।
কোনো কথা নেই, হোটেল বয় জিজ্ঞাসা করলো, ভাত খাইবা। ছেলেটি বললো ” হ্যাঁ “।
আচ্ছা, আমাকে শুধু ডালভাত দেয়া যাবে? দাম কতো পড়বে?
হোটেল বয় বললো, তুমি হাতমূখ ধুয়ে বসো। ডালভাত দেয়া যাবে, দাম মাত্র ২০ টাকা।
ছেলেটি হাতমুখ ধুয়ে বসতেই, হোটেল বয়, কিছু সবজি, একটি রান্না ডিম, একপ্লেট ভাত আর ডাউল দিয়ে, বললো, খাইয়া লও।
ছেলেটার চোখেমুখে বিব্রতের ছাপ, না না এতোকিছু না, আমাকে শুধ ডালভাত দিন, আমার কাছে টাকা এতো টাকা নেই।
হোটেল বয়, গামছা দিয়ে নিজের মুখ মুছে কইলো, তুমি খাইয়া লও, টাকার জন্যে তোমারে ভাবতে হইব না।
ছেলেটি ক্ষুধার্ত পেটে, খাবার গুলো খেয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে ক্যাশ টেবিলে বসে থাকা ম্যানেজারের সামনে দাঁড়াতেই,
হোটেল বয় বলে উঠলো, ওর বিল হয়েছে চল্লিশ টাকা, বিশ টাকা রাখেন, আর বিশ টাকা আমি দিমু।
ছেলেটি বিশ টাকা দিয়ে, খুব মায়াভরা চোখে হোটেল বয় এর দিকে চেয়ে আছে।… আপনি কেনো, আমার জন্য বিশ টাকা ব্যয় করলেন?
হোটেল বয় বললো, সমস্যা নেই, তোমার যখন টাকা হইবো অনেক বড়ো চাকুরী করবে, সেদিন শোধ কইরা দিও।
এরপর ঐ হোটেলটিতে ছেলেটির আর যাওয়া হয়নি। নিজের কাছে খুব ঋণী মনে হয়েছিল সেদিন ছেলেটির।
ক্ষুধার্ত সেই ছেলেটির নাম সৈকত। খুব মেধাবী ছাত্র। তার বাবা রিক্সা চালায়। মা কাগজের ঠোঙ্গা বানিয়ে বিক্রি করে। অভাবের সংসার।
বেশী ক্ষুধার্ত হয়ে যেদিন হোটেলে খেতে বসেছিল, সেদিন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হলো।
এরপর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পেয়েছে,সৈকত।
বাবা মায়ের কষ্টের সংসার, প্রাইভেট পড়িয়ে বাড়তি রোজগার করে লেখাপড়া চালিয়ে আসছে।
একদিন মোবাইল ফোনে, খবর পেলো, মায়ের অসুখ। তড়িঘড়ি করে বাড়িতে এলো। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বাবার রিক্সা চালানো আয়ের টাকায় দুদিন ঔষধ কেনা হয়েছে। আজকের ঔষধ কেনা টাকা নেই। কি করবে কোথায় টাকা পাবে?
বিষন্ন মনে ভাবছে সৈকত। চোখদুটো ছলছল করছে। আল্লাহর কাছে মনে মনে সাহায্য চাইছে, এছাড়া আর কিছুই করার নেই।
হটাৎ সেই হোটেল বয়, হাসপাতালে একজন রোগীর অর্ডার করা খাবার ডেলিভারি দিয়ে ফিরছিলো।… আরে সৈকত না!
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি এখানে? খাবার ডেলিভারি দিতে এসেছিলাম। তোমার চোখ মুখ শুকনো কেনো? কি হয়েছে আমাকে বলো?
সৈকত বললো মায়ের ঔষধ কিনতে পারছিনা,টাকা নেই।
এসো আমার সাথে, বলে একটা ফার্মেসিতে গিয়ে, ২০০/ টাকা জমা দিয়ে প্রায় ৬০০ টাকার ঔষধ ক্রয় করে দিয়ে বললো, আগে মাকে বাঁচাও।
সৈকত মায়ের ঔষধ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে দোতলা থেকে হোটেল বয় এর চলার পথের দিকে অপলক চেয়ে রইলো।
কে এই মানুষটি? পরনে ভালো পোশাক নেই। একটা হোটেলে সামান্য বেতনের চাকুরী করে, আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছে।
এই ঋণ আমি কি শোধ করতে পারবো? চিন্তিত সৈকত ভাবনার আকাশে ভাসতে ভাসতে মায়ের কাছে যায়।
সৈকতের মা সুস্থ্য হয়েছে। সৈকত অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদে চাকুরী পেয়েছে।
হঠাৎ একদিন বেশকিছু নেশাগ্রস্থ যুবকদের থানা হাজতে ঢুকিয়েছে ও,সি সাহেব।
ও,সি সাহেবের রুমে খুব পরিচিত এক কন্ঠে করুণ আবেদন এর কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।
স্যার, ওকে ছেড়ে দিন। ও আমার খুব আদরের ছোটো ভাই। ও কোনোদিন নেশা করেনি।
আমি সামান্য টাকা পাঠাই, তাতে ভাইটির লেখাপড়া চলেনা, প্রাইভেট পড়িয়ে কষ্ট করে লেখাপড়া চালায়।
স্যার, আসতে পারি? এসো এসো সৈকত, ওসি সাহেবের রুমে সৈকত ঢুকতেই চোখে পড়লো, সেই হোটেল বয়ের সাথে।
দুজন দুজনের দিকে অপলক চেয়ে রইলো। সৈকত বললো, আপনি এখানে?
হোটেল বয় বললো, স্যার আমার ছোটো ভাইকে ভুল করে নেশাখোরদের সাথে ধরে এনেছে।
না না, স্যার নয়, আমি আপনার ছোটো ভাই সৈকত হোটেল বয়কে বললো।
পুলিশের ইইউনিফর্ম পরে সৈকতকে দারুণ মানিয়েছে। হোটেল বয় চিনতে পারছিল না সৈকতকে।
থানা হাজত থেকে রাসেলকে ডেকে আনা হলো।
রাসেল হোটেল বয়ের ছোটো ভাই, সেও অনার্স পড়ছে। পার্কে বসে পেপার পড়ছিলো। পাশেই কিছু ছেলে নেশা করছিলো।
পুলিশের বাঁশী, দৌড়াদৌড়ি দেখে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়েছিল রাসেল। ব্যাস কোমরে রশি পড়ে গেল রাসেলের।
পুলিশের সন্দেহ, এই ছেলেটিও নেশাখোর। রাসেলের জবানবন্দি নিলেন ও,সি সাহেব। ছেলেটি সত্যিই নেশাখোর নয়।
সৈকত ও,সি স্যারকে হোটেল বয়ের মানবিক গুণাবলী সম্বন্ধে গল্প শোনালো, এবং হোটেল বয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, ইনি আমার বড়ো ভাই আর এই রাসেল আমার ছোটো ভাই।
ও,সি সাহেবের অফিস কক্ষ কিছুক্ষণের জন্য কান্নার রোল পড়ে গেলো, ও,সি সাহেব টিস্যু পেপার দিয়ে নিজের চোখ মুছলেন।
তারপর মুক্তি পেলো রাসেল। ও,সি সাহেব সহ, বড় একটি হোটেলে তারা দুপুরের খাবার খেলো, তৃপ্তি সহকারে।
আজীবন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বিনি সুতোয় গাঁথা হলো, সৈকত, রাসেল আর হোটেল বয়, যে লজ্জায় নাম বলতো না, সুমন আলির বন্ধন।
আরও পড়ুন
See more read more article
No Comments